দেশে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের একটি বড় অংশ এখনো থেকে যাচ্ছে পরীক্ষা নিরীক্ষার বাইরে, যা বড় ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার বাসিন্দা আরিফা সুলতানার স্বামী গত মাসের শেষের দিকে তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হন।
সেইসঙ্গে তিনি কাশি এবং শ্বাসকষ্টেও ভুগছিলেন, যার সবকটি কোভিড-১৯এ আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ। টানা ১৩ দিন অসুস্থ থাকার পর গত ৬ মে সুলতানার স্বামী মারা যান। তিনি জানেন না, তার স্বামী কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত ছিলেন কিনা। কারণ অনেক চেষ্টা করেও তিনি স্বামীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারেননি।
লাইনে দাঁড়িয়ে টেস্ট করানোর মতো অবস্থা তার স্বামীর ছিল না। আবার তার ধারণা উপর মহলে যোগাযোগ না থাকলে বাড়িতে এসে কেউ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করায় না। “নরমাল জ্বর ঠান্ডা হলে তো দুই তিন দিনেই সেরে যায়। কিন্তু ওর জ্বর তো নামছিলই না। প্রচণ্ড কাশি হচ্ছিল। আমাদের বড় কোন লিংক নাই যে বাড়িতে এসে টেস্ট করায় যাবে।
চেষ্টা করতে করতে তো ও চলেই গেল।” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন সুলতানা। বর্তমানে দুই সন্তান নিয়ে তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন। অনেক চেষ্টার পর কয়েকদিন আগে তিনি ও তার সন্তানদের নমুনা পরীক্ষা করাতে দিলেও এখনো কোন ফলাফল হাতে পাননি। সুলতানার স্বামীর মতো করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে ৯২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ- সিজিএস এর একটি জরিপে বেরিয়ে এসেছে।
যাদের কারো স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়নি। দেশের প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। ওই দিন থেকে গত ৯ মে পর্যন্ত দেশের ২৪টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই জরিপ প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিজিএস এর পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ। করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে এই মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।
তার মতে, এ ধরণের রোগীর সংস্পর্শে আসা প্রত্যেককে ঝুঁকিতে থাকেন এবং ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে টেস্টের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি দ্রুত টেস্টের কোন বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। “যতো টেস্ট বাড়বে বাংলাদেশে কোভিড ১৯ এর চিত্র আরও পরিষ্কার হবে।
সবচেয়ে ভালো হয় প্রতিদিন ২০ হাজার টেস্ট করলে। কারও মধ্যে উপসর্গ দেখা দিয়েছে কিনা, তাদের সবার টেস্ট হচ্ছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এতে কারও করোনাভাইরাস পজিটিভ থাকলে দ্রুত যেমন চিকিৎসা শুরু করা যাবে, তেমনি সংক্রমণও থামানো যাবে।” বলেন ইমতিয়াজ আহমেদ।
দেশে এখন যে পরিমাণ টেস্ট হচ্ছে, এই সংখ্যা আগের চাইতে বাড়লেও সেটা জনসংখ্যার অনুপাতে যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর এর ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান তাহমিনা শিরিন। বর্তমানে করোনাভাইরাস যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, সেক্ষেত্রে যাদের উপসর্গ আছে এমন কি যাদের উপসর্গ নেই সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
কেননা রোগী যদি কোভিড ১৯এ আক্রান্ত হন এবং সেটা যদি দ্রুত শনাক্ত করা যায় তাহলে তাকে আইসোলেশনে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দেয়া যাবে। এবং সংক্রমণও দমন করা যাবে। তাছাড়া যারা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যদি কোভিড ১৯ ধরা পড়ে তাহলে তারা সম্প্রতি যাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিনে নেয়া জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে যখন করোনাভাইরাসের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয় তখন তিনটি বিষয় ভিত্তিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হতো। প্রথমত ওই ব্যক্তির করোনাভাইরাসের উপসর্গ আছে কিনা, গত দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি বিদেশে ভ্রমণ করেছিলেন কিনা এবং বিদেশে ভ্রমণ করেছেন এমন কারও সংস্পর্শে এসেছিলেন কিনা।
কিন্তু দেশে এখন যেহেতু করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে অর্থাৎ কার মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছেন সেটা বের করা যাচ্ছে না, সেক্ষেত্রে কতো সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, সেটা বের করতে টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে বলে তাহমিনা শিরিন মনে করছেন। এছাড়া কী পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, কিভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে, কিভাবে দ্রুত টেস্টের ফলাফল নিশ্চিত করা যাবে এ ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনার প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
যাদের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ আছে অথবা যারা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন তাদের সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে স্বাস্থ্য অধিদফতর কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক শাহনীলা ফেরদৌস। ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরিধি আরও বাড়ানো হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। শাহনীলা ফেরদৌস বলেন,
“যাদের উপসর্গ আছে বা কেউ উপসর্গ নিয়ে মারা গেলে, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা আমরা করতে চাই। কিন্তু অনেক পরিবার নমুনা সংগ্রহের আগেই দাফন সম্পন্ন করে ফেলেন। কিন্তু এই প্রত্যেকটি মৃত্যুর কারণ সরকার বের করতে চায়। আমরা চাই না কোন মৃত্যু অপরীক্ষিত থাকুক।”
শুরুতে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজটি আইইডিসিআর এককভাবে করায় সমন্বয়হীনতার দেখা দিয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। “আইইডিসিআর এর মূল কাজ হল গবেষণা, তাদের পক্ষে এতো বিপুল পরিমাণ টেস্ট সামাল দেয়া কোন সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর দায়িত্ব নেয়ার পর অনেকটাই গুছিয়ে আনা গিয়েছে।” তিনি বলেন।
টেস্টের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে ল্যাবরেটরির সংখ্যা এবং নমুনা সংগ্রহের বুথের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি। তার তথ্যমতে, বর্তমানে ৪১টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা চলছে। এছাড়া যারা বাইরে গিয়ে টেস্ট করাতে পারছেন না, তাদের নমুনা বাড়িতে গিয়ে সংগ্রহ করার জন্য ১৭টি টিম কাজ করছে। বিবিসি।