Breaking News

ধাপ্পাবাজি করে প্রণোদনার টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই

করোনার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য বিপর্যস্ত। চলমান সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় মহা সংকটে পড়েছেন দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা। করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় এরই মধ্যে এক লাখ টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ প্যাকেজকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি বলেছেন, প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরাই পাবেন। এখান থেকে কোনো ধরনের ধাপ্পাবাজি করে টাকা বের করে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাঁর মতে, চলমান সংকট দীর্ঘায়িত হলে ব্যবসায়ীদের খেলাপি না করার সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো উচিত। তবে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ঋণ মওকুফের যে দাবি উঠেছে সেটা সংগত নয়। তবে সরকার থেকে বেলআউট প্যাকেজ কর্মসূচিতে ভর্তুকি হিসেবে ব্যাংকগুলোকে সুদ মওকুফের খরচ জোগান দিলে তা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যারা দীর্ঘদিন ফেরত দিচ্ছে না তাদের নতুন করে ঋণ না দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি। গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন তিনি।

ঋণের সুদ মওকুফের দাবির বিষয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ঋণের সুদ কী করে মাফ করা সম্ভব। ব্যাংকের টাকা তো জনগণের, আমানতকারীর। ব্যাংকে উদ্যোক্তাদের তো সামান্য টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর যারা স্পন্সর উদ্যোক্তা তাদের শেয়ার আছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। বাকি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হলো

জনগণের শেয়ার। ব্যাংকে সুদ বা লাভের আশায় টাকা রাখে আমানতকারীরা। আমরা যারা বিনিয়োগকারী, ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিই, এর সুদ ৯ বা ১০ শতাংশ। ধরেন ব্যাংকগুলো এই ঋণের সুদ মাফ করে দিল, তাহলে জনগণের আমানতের সুদ দেবে কোথা থেকে। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, অফিস ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ কোথা থেকে আসবে। ব্যাংক তো দেউলিয়া হয়ে যাবে। তাই আমার মনে হয় না, প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কোনো কথা বলেছেন।

সম্প্রতি জেলা পর্যায়ে ভিডিও কনফারেন্সে এ ধরনের ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন এ কথা স্মরণ করে দেওয়ার পর তিনি বলেন, আসলে সুদ মওকুফের দাবি ন্যায়সংগত নয়। আমিও ব্যবসা করি। আমিও বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি। এর মানে আমি একদিকে ব্যবসায়ী অন্যদিকে ব্যাংকার। তাহলে সুদ মওকুফটা আমি চাইব কী করে। এটা শুধুমাত্র স্পেশাল কেসের ক্ষেত্রে হতে পারে। যেমন কোনো লোক মারা গেছে তার সুদটা মাফ হতে পারে। একটা কারখানায় আগুন লেগে কারখানার পুরো মূলধন চলে গেছে অথবা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগে একটা জিনিস ধ্বংস হয়ে গেছে সেটা মাফ হতে পারে। এখন যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এটা কোনো ইনডিভিজুয়াল না। এটা সারা দেশের। তবে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিলে সুদ অবশ্যই মাফ করতে হবে। নিশ্চয়ই এটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মনের ভেতর অন্য কিছু আছে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্য সরকারের বেলআউট প্যাকেজ কর্মসূচির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বড় সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে বেলআউট প্যাকেজের ঘোষণা দেওয়া হয়, যেখানে সরকার বা রাষ্ট্র ফান্ডিং করে। অর্থাহৃ সুদ মওকুফের কারণে যে পরিমাণ টাকা খরচ হবে, ওই পরিমাণ টাকা সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে। হয়তো প্রধানমন্ত্রী এ রকম কোনো চিন্তা করেছেন। সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ ধরনের কোনো বেলআউট প্রণোদনা ছাড়া ঋণের সুদ মওকুফ করা সম্ভব নয়।

ব্যবসায়ীদের খেলাপি না করার সময় ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জুনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠিক হয়ে যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। ইতালিসহ অন্যান্য দেশে আগে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও এখনো বন্ধ হয়নি। আমাদের দেশে আরো পরে শুরু হয়েছে। এখনো প্রতিদিনই করোনা রোগীর হার বাড়ছে। এ অবস্থায় আমরা অর্থমন্ত্রীকেও বলেছি চলমান সংকটে ব্যবসায়ীরা টাকা ফেরত দিতে পারছে না। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কবে দিতে পারবে সেই নিশ্চয়তাও নেই। ফলে খেলাপি ঋণও বেড়ে যাবে। কাজেই ব্যবসায়ীদের খেলাপি না করার সময় আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো না হলে প্রতিটি ব্যাংকের ব্যালান্স শিট নেগেটিভে চলে যাবে। ফলে বিদেশি ব্যাংকগুলো আমাদের এলসি একসেপ্ট করবে না। দাতা সংস্থাগুলো সহজ শর্তে ঋণ দেবে না। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বলবে তোমাদের রেটিং খারাপ হয়ে গেছে।

যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে আসছেন এবং করোনা দুর্যোগের কারণে এখন পরিশোধ করতে পারছেন না তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন ঋণ দরকার। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রস্তুতি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঋণের ব্যবসা করাই ব্যাংকের কাজ। ব্যবসা না করলে ব্যাংক তাদের ওভারহেড কষ্ট কোথা থেকে মিট করবে। কাজেই যারা ভালো গ্রাহক, যাদের সুনাম-সুখ্যাতি আছে, তারা এই দুর্যোগে খেলাপি হলে তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য অবশ্যই নতুন ঋণ দিতে হবে এবং আমরা ঋণ দিয়ে যাব।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ কিভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত অভিজ্ঞ। উনি জানেন টাকাটা কিভাবে দিতে হবে। এরই মধ্যে রপ্তানি খাতের জন্য ঘোষিত পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাব এবং মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ ও রকেট মাধ্যমে সরাসরি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মনে খারাপ কিছু বা অসহৃ উদ্দেশ্য থাকতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে ওই তহবিলের টাকা এদিক-সেদিক করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। অন্য প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় দেখেশুনে যাচাই-বাছাই করে বিতরণ করা হবে। আমার মনে হয় যারা ভালো ব্যবসায়ী ও ঋণগ্রহীতা তাঁরাই প্রণোদনার সুবিধা পাবেন। যারা ঋণখেলাপি, দীর্ঘদিন টাকা ফেরত দেন না তাঁদের কোনো ব্যাংক এ সুবিধা দেবে না এবং আমরাও দেব না।

ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে যাঁরা ফেরত দিচ্ছেন না, তাঁদের নতুন করে ঋণ না দেওয়ার যে দাবি উঠেছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তাঁদের নতুন করে ঋণ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। তিনি বলেছেন, যাঁরা টাকা নিয়ে গেছেন তাঁদের ফাঁসি বা যাবজ্জীবন জেল দিলেই তো আর টাকা ফেরত আসবে না। তাই তাঁদের থেকে টাকা আদায় অ্যাসিস্ট ম্যানেজমেন্ট কম্পানি করবে। তবে আমি মনে করি টাকা নিয়ে যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে ফেরত না দিয়ে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করেছেন, ভালো এয়ারকন্ডিশন বাড়িতে থাকছেন, পাজেরো গাড়িতে চড়ছেন, বিজনেস ক্লাসে দেশ-বিদেশে সফর করছেন তাঁদের জন্য শাস্তির একটা বিধান থাকতে হবে। তাঁদের যে অ্যাসেট আছে তা সমন্বয় করে যে ব্যালান্স থাকবে, সেটার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দেউলিয়া আইন পাস করে দেউলিয়া ঘোষণা করা উচিত। পাশাপাশি তাঁদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।

এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর কী ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা থাকবে জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, খেলাপিরা কোনো টাকাই নিতে পারবে না। কারণ তাঁদের সিআইবি খারাপ। আর যাঁদের সিআইবি খারাপ থাকে তাঁকে ঋণ দেওয়া কোনো ব্যাংকের এমডিরও সাহস হবে না। তা ছাড়া কেন্দ ীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে কোনো ঋণখেলাপি প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা নিতে পারবে না।

খেলাপি ঋণ কমাতে বিএবি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে কি না—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমানো ব্যবসার ওপর নির্ভর করে। আমরা যদি দেখি প্রথম পাঁচ বছর কেউ ভালো ব্যবসা করেছে, এরপর দুই বছর তাঁর ব্যবসা খারাপ হয়ে গেছে, তাঁকে ব্যাংকই ইনডিভিজুয়াল অর্থায়ন করে যাচ্ছে। আবার যদি দেখি ব্যবসা খারাপের কারণে কেউ খেলাপি হয়ে গেছে কিন্তু তার ইন্ডাস্ট্রিসহ সব কিছুই আছে। বর্তমানে ১০০ কোটি টাকার ঋণ আছে। ১০ কোটি টাকা ঋণ দিলে তিনি ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। তাঁকেও আমরা ঋণ দিয়ে আসছি। করোনা সংকট কেটে ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হলে খেলাপি ঋণ কমে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।

প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা যাতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা পায় সেই ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়—এরই মধ্যে এ বিষয়ে পদপে নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এটা মনিটর করছেন। সচিব, মুখ্য সচিবসহ অন্যরা এগুলোর বিতরণের বিষয়টি দেখছেন।

রাজনৈতিক চাপমুক্তভাবে প্রণোদনা সুবিধা সবার মধ্যে বণ্টন করা সম্ভব কিনা—প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি নিজে রাজনীতি করি না। প্রণোদনা প্যাকেজ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনীতির কোনো কিছু আছে বলেও আমি মনে করি না। এটা সর্বদলীয় প্রণোদনা প্যাকেজ। যেমন রপ্তানি খাতের পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের মধ্যে বিভিন্ন দলেরই আছে। আবার যাঁরা গার্মেন্টের মালিক তাঁদের মধ্যে কেউ বিএনপির আছেন, কেউ আওয়ামী লীগের আছেন, কেউ জাতীয় পার্টির আছেন, আবার কেউ জামাতেরও আছেন। করোনা দুর্যোগকালীন সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলো নতুন কোনো পণ্য আনবে কি না বা বিএবির পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এই প্রশ্নের জবাবে বিএবির চেয়ারম্যান বলেন, বিএবির পক্ষ থেকে যারা দিন আনে দিন খায়, হতদরিদ্র মানুষ, তাদের সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংক নিজ উদ্যোগে প্রত্যেক জেলায় ত্রাণ বিতরণ করছে, যাতে এ শ্রেণির মানুষ ধার-কষ্ট না পায়। এ ছাড়া বিএবির উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে প্রত্যেকটা ব্যাংক পাঁচ কোটি টাকা করে অনুদান দিয়েছে। অন্যদিকে ব্যাবসায়িক ব্যাপারে অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্য যেসব কাজ করতে হবে সেটা নিজস্ব উদ্যোগে ব্যাংকগুলো করতে পারে না। কারণ প্রত্যেকটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো প্যাকেজ পেলে বা নতুন কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা পেলেই এটা সম্ভব।

তিনি বলেন, করোনার কারণে বিদেশের সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাচ্ছে। ফলে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য আরো বেগবান করার জন্য সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে আবাসন, কৃষিজাত পণ্য, মত্স্য, গরুর খামার, পোল্ট্রিসহ অন্যান্য দেশীয় শিল্পকে আরো বেগবান করার জন্য সহজ ও স্বল্প সুদে প্রণোদনা প্যাকেজ নেওয়া যেতে পারে।

Check Also

দক্ষ সংগঠক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য তিনি দায়িত্বশীলদের প্রতি আহ্বান: ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরীর দায়িত্বশীলদের ২য় সাধারণ অধিবেশন ২৮ আগস্ট বিকেল ৫.৩০টায় চট্টগ্রাম মহানগরী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *