দেশে নভেল করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তির মৃত্যুর ঘোষণা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আগের জনের মতোই তার পরিচয়ও গোপন রেখেছে সরকার। তবে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মারা যাওয়া ব্যক্তি ঢাকার একটি সরকারি মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ। সরকারি বিধিনিষেধ মেনেই মৃত ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হলো না।
শুক্রবার রাত সাড়ে ৩টায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যাওয়া এ ব্যক্তির মরদেহ গতকাল সকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দাফন করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা এ শিক্ষাবিদের চিকিৎসা, মৃত্যু ও দাফন-সংক্রান্ত সব তথ্য বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন তার নিকটাত্মীয়রা।
অসুস্থ হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ১০ দিনের রোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া গেছে ওই শিক্ষাবিদের পরিবার থেকে। একই সঙ্গে উঠে এসেছে করোনা নিয়ে সরকারি অব্যবস্থাপনার চিত্রও। তার পরিবারের অভিযোগ, বহু চেষ্টা করেও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) থেকে করোনা পরীক্ষার সুযোগ পাননি আক্রান্ত ব্যক্তি। পরে উচ্চপর্যায়ের তদবিরেই করোনা পরীক্ষার সুযোগ মিলেছিল আক্রান্তের। করোনাভাইরাস ধরা পড়ার পরের দিনই বরেণ্য ওই শিক্ষাবিদের মৃত্যু হলো।
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সর্দি, কাশি ও জ্বরে ভুগছিলেন তিনি। এজন্য নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছিলেন তিনি। শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় কী রোগ হয়েছে, তা পরীক্ষার জন্য রাজধানীর একাধিক হাসপাতালে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই পরীক্ষার সুযোগ পাননি। গত সোমবার থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার। এ শিক্ষাবিদের উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত সন্তানরা পিতাকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডাক্তারের কাছে ছুটে যান।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন এ শঙ্কা থেকে ১৭ মার্চ সকাল থেকে রোগীর স্বজনরা যোগাযোগ করেন আইইডিসিআরে। প্রতিষ্ঠানটির দেয়া হটলাইনে বহু চেষ্টা করে সংযোগ পাওয়া যায়। রোগীর কাছ থেকে বিস্তারিত শোনার পর আইইডিসিআর থেকে বলা হয়, কোনো সমস্যা নেই। স্বাভাবিক জ্বর-সর্দি জানিয়ে রোগীকে বাসায় বিশ্রামে থাকতে বলা হয়।
কিন্তু ওইদিন (১৭ মার্চ) দুপুর থেকে শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে ওই শিক্ষাবিদের। বাধ্য হয়ে রোগীকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় আইসিইউতে স্থানান্তরের প্রয়োজন হয় রোগীকে। কিন্তু ওই হাসপাতালে আইসিইউ খালি না থাকায় ওইদিন সন্ধ্যায় মিরপুর-১ এলাকার অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
বুুধবার ওই শিক্ষাবিদের আত্মীয়রা আইইডিসিআরে গিয়ে রোগীর করোনা পরীক্ষার জন্য তদবির করেন। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে ফোন করিয়ে অবশেষে করোনা পরীক্ষায় রাজি করাতে সফল হন তারা। আইইডিসিআরের এক কর্মী মিরপুরের ওই হাসপাতালে গিয়ে রোগীর নমুনা নিয়ে আসেন। সে নমুনা পরীক্ষা করে বৃহস্পতিবার বিকালে আইইডিসিআর থেকে জানানো হয় ওই শিক্ষাবিদ করোনায় আক্রান্ত।
বিষয়টি জানতে পেরে বেসরকারি হাসপাতালটি থেকে ওই সময়ই রোগীকে সরিয়ে নিতে চাপ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সরকার থেকে হাসপাতালটিতে রোগীকে আইসিইউতে রাখতে বাধ্য করা হয়। এ অবস্থার মধ্যেই শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বেড়ে শুক্রবার রাত সাড়ে ৩টায় এ শিক্ষাবিদ মৃত্যুবরণ করেন। গতকাল সকালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় তার মরদেহ রাজধানীর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ সময় তার পরিবারের কয়েক সদস্য জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে করোনায় আক্রান্ত এ শিক্ষাবিদকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন তার সন্তানরা। পিতার মৃত্যুর পর এখন তার দুই ছেলে, এক মেয়ে, নিকটাত্মীয়সহ অন্তত ১০ জন করোনার ঝুঁকিতে আছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। মৃত ওই শিক্ষাবিদ বসবাস করতেন রাজধানীর মিরপুরের উত্তর টোলারবাগে নিজ বাড়িতে। তার পরিবার কিংবা ওই বাড়িতে বসবাসকারী কোনো সদস্য সম্প্রতি বিদেশ সফর করেননি বলে নিশ্চিত হয়েছে বণিক বার্তা।
ঠিক কোত্থেকে বা কার মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাস প্রবেশ করেছে, সে বিষয়েও অজ্ঞাত পরিবারের বাকি সদস্যরা। এ বিষয়ে মৃত শিক্ষাবিদের পরিবারের সদস্যদের গণমাধ্যমে কথা বলতে সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে কল্যাণপুর ও মিরপুরের ওই দুটি হাসপাতালের দায়িত্বশীল কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি। করোনা আক্রান্ত ওই রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়সহ সংশ্লিষ্টদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, এখন পর্যন্ত দেশে সরকারের পক্ষ থেকে একমাত্র পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করছে আইইডিসিআর। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষাধিক প্রবাসী দেশে এসেছেন। এদের অনেকেই এসেছেন সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে। এখন পর্যন্ত ২৪ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্তের কথা জানিয়েছে সরকার। আইইডিসিআর ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে সরকার করোনার নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেয়নি। আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, করোনা পরীক্ষার সমন্বয় করার জন্যই এ পরীক্ষার অনুমতি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে এখনই দিতে চায় না তারা।
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য উন্নত মানের বায়োসেফটি ল্যাবের প্রয়োজন পড়ায় এ সিদ্ধান্তে এখনো অটল রয়েছে সরকার। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনার লক্ষণ আছে, এমন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে যত বেশি সম্ভব পরীক্ষার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিয়েছে, যাতে দ্রুত রোগী শনাক্ত করে তাদের আইসোলেশনে নেয়া যায়। নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে নেয়া সম্ভব হলে করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রম শক্তিশালী করা যাবে বলে মনে করে ডব্লিউএইচও।bonikbarta.net